একাদশে বৃহস্পতি:
১৯৫০-৬০–এর দশকের কথা। ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডবলীলা মাত্র নিভতে শুরু করেছে। প্রলয়ংকরী যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য থেকে যেন ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জন্ম হলো সৃজনশীলতার। বিজ্ঞানের চাকা ছুটছে তুমুল গতিতে। পাল্লা দিয়ে কাজ করছে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন, চলছে তীব্র প্রতিযোগিতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুতনিক-১ প্রেরণের মাধ্যমে মহাকাশ যুগের সূচনা করে। সোভিয়েতের এই সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে হাহাকার পড়ে যায়। ফলাফল হিসেবে আমেরিকা মহাকাশ গবেষণায় লগ্নি করা শুরু করে এবং সৃষ্টি হয় নাসার। ইউএস নেভির সহায়তায় নাসায় তখন মহাকাশ নিয়ে গবেষণা তুঙ্গে। মানুষ পাঠানোর আগে মহাকাশের পরিবেশ মহাকাশচারীদের ওপর কী প্রভাব ফেলে, তা বুঝতে বিজ্ঞানীরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তারই অংশ হিসেবে সে সময় নাসা ও ইউএস নেভি বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত তৎকালীন গ্যালোডেট কলেজের ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রায় ১০০ জন স্বেচ্ছাসেবককে তারা আমন্ত্রণ জানায় এসব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে। প্রায় এক দশক ধরে চলা এই পরীক্ষাগুলো যাঁরা পরিচালনা করছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন অ্যাশটোন গ্যাব্রিয়েল। ভদ্রলোক পেশায় একজন চিকিৎসক, হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি মহাকাশচারীদের ওপর এই মহাশূন্যে অভিযান যেসব সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, তা থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে চিন্তা করছিলেন।
মহাকাশচারীরা যখন রকেটে ভ্রমণ করবেন, তখন তাঁদের গতিবেগ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হবে। তাই তীব্র গতির কারণে মাথা ঘোরা, বমি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেবে; যাকে ইংরেজিতে মোশন সিকনেস বলা হয়ে থাকে। মোশন সিকনেসের হাত থেকে তাঁদের বাঁচানোর উপায় সম্পর্কে জানতে নাসা বিশেষভাবে আগ্রহী ছিল। এ ছাড়া পৃথিবীর বাইরে আমাদের জন্য অস্বস্তিকর ও অস্বাভাবিক মহাকর্ষীয় বল কেমন প্রভাব ফেলবে, তা নিয়েও গবেষণা চলছিল। তখনকার দিনে জীববিজ্ঞান যত দূর এগিয়েছিল, তা থেকে ধারণা করা হতো যে মোশন সিকনেসের জন্য আমাদের পাকস্থলী দায়ী। পরীক্ষাগুলোয় স্বেচ্ছাসেবকেরা যখন মোশন সিকনেস অনুভব করছেন, তখন তাঁদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া কেমন হচ্ছে, তা ধারণ করে রাখার মতো উপযুক্ত ক্যামেরা বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্র তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই তাঁদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কী ধরনের আচরণ করছে, সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হতো সম্ভাব্য সব উপায়ে, যেমন তাঁদের রক্তচাপ ও হৃৎকম্পন কত ছিল, হজমে সমস্যা হচ্ছে কি না, রক্ত ও মূত্র পরীক্ষায় অসামঞ্জস্য আছে কি না, চোখ নাড়াতে সমস্যা হচ্ছে কি না ইত্যাদি।
দেখা গেল, এসব পরীক্ষায় বধির ব্যক্তিরা, অর্থাৎ যাঁদের শ্রবণেন্দ্রিয় নেই, তাঁরা মোশন সিকনেসে আক্রান্ত হচ্ছেন না। কিন্তু যাঁদের এই সমস্যা নেই, অর্থাৎ সুস্থ, স্বাভাবিক শ্রুতিক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মোশন সিকনেসে আক্রান্ত হচ্ছেন। অদ্ভুতুড়ে এই প্রাথমিক ফলাফল থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁরা স্বাভাবিক ও বধির ব্যক্তিদের দুটি দলে বিভক্ত করে তাঁদের ওপর একই ধরনের পরীক্ষা চালিয়ে সেগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করবেন। সেই উদ্দেশ্যে গ্যালোডেট কলেজের ২৫-৪৮ বছর বয়সী ১১ জন বধির স্বেচ্ছাসেবককে এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
প্রায় এক দশক ধরে এই ১১ জনকে নিয়ে প্রতিকূল অবস্থায় অনেকগুলো চরম পরীক্ষা করা হয়। সেগুলোতে তাঁরা শারীরিক ও মানসিক সহ্যসীমার চূড়ান্তে পৌঁছে যান। এই পরীক্ষাগুলো করার উদ্দেশ্য ছিল মূলত মহাকাশের বৈরী পরিবেশে মানবদেহে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে এবং মানবদেহ কীভাবে সেই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, তার প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করা। যেমন একটি পরীক্ষায় টানা ১২ দিন তাঁদের একটি ২০ ফুট ব্যাসের গোলকাকৃতির কক্ষে রাখা হয়। কক্ষটি প্রতি মিনিটে ১০ বার ৩৬০ ডিগ্রি কোণ পরিমাণ ঘুরতে পারে। চরকির মতো সেই কক্ষে ঘুরতে ঘুরতে সুস্থ মানুষেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, বমি করে ভাসিয়ে ফেলছেন। কিন্তু বধির ব্যক্তিদের মধ্যে এ ধরনের বিরূপ প্রভাব দেখা গেল না।
আরেকটি পরীক্ষার জন্য তাঁদের নেওয়া হয় ভমিট কমেট নামের একধরনের উড়োজাহাজে। এই উড়োজাহাজের গতি এমন, যাত্রীরা মাঝেমধ্যে কিছু সময়ের জন্য জিরো গ্র্যাভিটি বা ওজনহীনতা অনুভব করতে পারেন। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হলে বমি হতো বলে এই বিশেষ নামকরণ। ওজনহীনতার জন্য বধির ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো শারীরিক সমস্যাই দেখা গেল না।
এ ছাড়া ওই ১১ জনকে নিয়ে আরও কিছু পরীক্ষা করা হয়। যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ১০২ তলা উঁচু এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে নিচে তাঁদের লিফটে ওঠানো-নামানো করা হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা ঘটে ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় নর্থ আটলান্টিক সাগরে। উত্তাল সমুদ্রে দুলতে থাকা জাহাজের যাত্রীরা সাধারণত মোশন সিকনেসসহ আরও কিছু সমস্যায় আক্রান্ত হন। তাই এই পরিস্থিতিতে তাঁদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কী ধরনের আচরণ করে, তা নিয়ে গবেষণা করাই ছিল এই যাত্রার আসল উদ্দেশ্য। অশান্ত সমুদ্রে বাংকার রুমে তাঁরা হাসিঠাট্টায় মশগুল। তাসের আসরে ইশারা-ইঙ্গিতে বা লিপ রিডিং করে গল্পের খই ফুটছে। সাগরের অবাধ্য ঢেউ, প্রলয়ংকরী ঝড়—কিছুই যেন তাঁদের শারীরিকভাবে কাবু করতে পারছে না। এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ জরুরি খবর এল, এই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে, দ্রুত তাঁদের তীরে ফিরে আসতে হবে। কারণ, সুস্থ, স্বাভাবিক যেসব বিজ্ঞানী ও গবেষক বধিরদের শরীরের বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করছিলেন, তাঁরাই এই উত্তাল সমুদ্রে মোশন সিকনেসে আক্রান্ত!
বধিরদের জাদুকরি ক্ষমতার উৎস কী, তা বের করতে নাসা উঠেপড়ে লেগে যায়। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে তাঁদের অন্তঃকর্ণে। ১১ জনের সবাই ছোটবেলায় স্পাইনাল মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে তাঁদের অন্তঃকর্ণের ভেস্টিবুলার সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভেস্টিবুলার সিস্টেম মস্তিষ্ককে দেহের গতি সম্পর্কে তথ্য পাঠায় এবং দেহের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমরা যখন কোনো দিকে গতিশীল হই, তখন এই ভেস্টিবুলার সিস্টেম মস্তিষ্ককে সিগন্যাল দেয়, দেহ কোন দিকে গতিশীল। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, আমরা গাড়িতে চড়ে কোথাও যাচ্ছি। তখন যদি একটা বই পড়ার চেষ্টা করি, তাহলে চোখ মস্তিষ্ককে সিগন্যাল দেবে, দেহ স্থির হয়ে আছে, কিন্তু গতি জড়তার কারণে আমাদের অন্তঃকর্ণের সেই ভেস্টিবুলার সিস্টেম সিগন্যাল দেবে, আমাদের দেহ এখনো গতিশীল অবস্থায় আছে। দুই পরস্পরবিরোধী বার্তা পেয়ে আমাদের মস্তিষ্ক দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। তারই ফল হলো এই মোশন সিকনেস। ভিজ্যুয়াল আর ভেস্টিবুলার সিস্টেমের এই ভিন্ন সিগন্যাল আমাদের মস্তিষ্ককে দ্বিধায় ফেলে দেয় বলে এই তত্ত্বকে বলা হয় সেন্সরি কনফ্লিক্ট থিওরি।
যেহেতু গ্যালোডেট কলেজের ওই ১১ ব্যক্তির কান আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ছিল, তাই তাঁরা কখনো মোশন সিকনেসে আক্রান্ত হতেন না। এই পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসকেরা ওষুধ তৈরি করার চেষ্টা করেন, যাতে সুস্থ মানুষকে এই মোশন সিকনেসের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। এই বধির একাদশ আসলে গোটা মানবজাতির জন্যই ছিল একাদশে বৃহস্পতিস্বরূপ। এই গবেষণার ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ধারণা করা হয়, এই গবেষণার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র চাঁদে যাওয়ার দৌড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়।
নাসার একসময়ের প্রধান ইতিহাসবিদ উইলিয়াম পি ব্যারি বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক দিন যাবৎ মহাকাশে মানুষ পাঠানো বন্ধ রেখেছিল। আমরা এর কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে জানা গেল, তাঁদের দ্বিতীয় নভোচারী মহাকাশযাত্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি হলো বিজ্ঞানে পৃথিবীর যে কেউ অবদান রাখতে পারে; মানুষের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিশ্বাস, চরিত্র, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, শারীরিক অক্ষমতা ইত্যাদি কিছুই এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। গ্যালোডেট কলেজের সেই ১১ জন বধির ব্যক্তি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, শারীরিক সীমাবদ্ধতাসম্পন্ন মানুষেরা অক্ষম নন; বরং বিশেষভাবে সক্ষম এক অমূল্য মানবসম্পদ। তাঁরা নিজেরা হয়তো মহাকাশে যেতে পারেননি, কিন্তু তাঁদের মতো অসংখ্য মানুষের অবদানের কারণেই আমরা একদিন উড়ে গিয়েছি অনন্ত নক্ষত্রবীথির পানে।
লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: অক্সফোর্ড রেফারেন্স ডটকম
*লেখাটি ২০২০ সালে বিজ্ঞানচিন্তার ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত
Thank you for information.
ReplyDelete